এই ঘটনাটাকে কেবল অস্বাভাবিক বলিলেই চলিবে না—ইহা একপ্রকার মানসিক ভূমিকম্প। যে ছেলে কণ্ঠ ফাটাইয়া গালিগালাজে পারদর্শী ছিল, খুন্তি হাতে মদ খাইয়া পথে নামিত, হঠাৎ সে কবিতা লিখিতে আরম্ভ করিল। হ্যাঁ, ঠিক শুনিতেছেন—কবিতা!
গ্রামের মোড়ে বসিয়া যে ছেলেটা অশ্লীল ছড়া গাইয়া বাহবা লুটিত, সে এখন নদীর ধারে বসিয়া লিখে—“বাঁশির সুরে জেগে ওঠে আকাশের নীল অরণ্য।” এ কি সম্ভব? লোকজন প্রথমে হাসিয়া উড়াইয়া দিল, পরে অবিশ্বাস করিল, তারপর একসময় থমকে দাঁড়াইয়া ভাবিল—আচ্ছা, সত্যিই কি সে বদলাইয়া গিয়াছে? এ কি ঈশ্বরের খেলা? না কি কোনো মানসিক ব্যাধি?
মেয়েরা কানে কানে বলিল—”গঙ্গার জল খাইছে মনে হয়। না হইলে ডাইল-ভাত খেয়ে এমন কথা মুখে আসে?”
যে বংশে তার জন্ম, সে বংশে মানুষ জন্মে চোর হয়, জুয়াড়ি হয়, দরকার পড়িলে খুন করিতে দ্বিধা করে না—কিন্তু কবি? ও বংশে কেউ কভু কলম ধরিয়াছে, এমন কথা কেহ শুনে নাই। তারা ঝাঁটার হাতল ধরে, না হয় লাঠি। কলমে তো রক্ত উঠে, কালি নয়।
তার নাম রতন। রতন কর্মকার। বাবা লোহার কাজ করিত, পাথর ভাঙিতে গিয়া মরিয়াছিল। মা মরিল লোহার কামড়ে—তাল পাখার হাতলে বৈদ্যুতিক তার জড়াইয়া ছিল। সংসার আগেই ছিন্ন, রতনের শৈশব কাটিয়াছে গরু চরাইয়া, আর মাঠের পটল চুরি করিয়া।
তার মামা গোবিন্দ কর্মকার, যাকে গ্রামে “গোব্বা ডাকাত” বলিয়া ডাকা হয়, কারণ তিনবার থানার ফাঁদ ফাঁকি দিয়াছে—একবার তো নাকি হাতকড়ি সহই গাছে উঠিয়া চম্পট।
এমন এক পরিবেশে, এমন এক অতীতের ছায়ায় বেড়ে ওঠা রতন হঠাৎ যখন কাগজে লিখিতে লাগিল—”জলপাই পাতায় বৃষ্টি নামে, বুকের গোপন স্মৃতির মতো”—তখন লোক চমকিত না হইয়া উপায় ছিল না।
এ যেন অন্ধকারে হঠাৎ বিজলির রেখা, বা পুরাতন কুয়োর জলে পদ্মফুল ফোটার মতো বিস্ময়।
গ্রাম বলিয়া উঠিল—“রতন পাগল হইয়া গিয়াছে।”
আর কিছু মনস্ক জন বলিল—“না ভাই, পাগল না—এ কোনো খেলা নয়, এ বড় কিছু ঘটিবার লক্ষণ।”
| Title | কবি |
| Author | তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, Tarashankar Bandyopadhyay |
| Publisher | প্রিমিয়াম পাবলিকেশন্স |
| ISBN | |
| Edition | 1st |
| Number of Pages | 256 |
| Country | Bangladesh |
| Language | Bengali, |
0 Review(s) for কবি