• 01914950420
  • support@mamunbooks.com
"আমি কে?" বইটির ভুমিকা থেকে নেয়াঃ
‘আমি কে' এই জিজ্ঞাসা মানুষের চিরন্তন। এটি প্রত্যেক মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। যুগে যুগে দার্শনিকরা নিজ নিজ ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেক মানুষও হয়তাে নিজের মত করে এর এক রকম একটি উত্তর গড়ে নেন। তবে কারাে জন্যই প্রশ্নটি সহজ নয়। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে এসে এ নিয়ে তত্ত্ব দিয়েছেন প্রধানত সমাজবিজ্ঞানী ও মনােবিজ্ঞানীরা। অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানীরা এর উত্তরের জন্য তাকাতে বলতেন যার যার সমাজের দিকে, কালচারের দিকে। এর কারণ তাঁরা মনে করতেন মানুষের শুরুটি হয় একটি পরিস্কার শ্লেট বা সাদা খাতার মত শূন্য অবস্থায়; পরে বাইরের শিক্ষা, সমাজ, কালচার ইত্যাদি ক্রমে ক্রমে এই সাদা খাতার ওপর লিখে লিখে আজকের ‘আমি’কে তৈরি করেছে। অধিকাংশ মনােবিজ্ঞানীরাও দেখতে চাইতেন বাইরের নানা উত্তেজনায় এক এক জন কী ভাবে সাড়া দিচ্ছে, আচরণ করছে, সেখান থেকেই মিলবে তার আত্ম-পরিচয়। তাঁদের কাছেও মন জিনিসটা ছিল সাদা খাতার মতই একটি নিরপেক্ষ জিনিস যাকে ইচ্ছেমত গড়া যায়। তারা ভাবতেন মনের কাজের কলকজা মস্তিষ্কের মধ্যে আছে বটে, তবে মন নিজে মস্তিষ্কের সঙ্গে আটকে নেই। সে স্বাধীনইচ্ছায় চলে, দেহের বাধ্যবাধকতায় থাকেনা। কাজেই এই উভয় দৃষ্টিভঙ্গিতেই ‘আমি কে' এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাকে শুধু বাইরের দিকে তাকাতে হবে। সমাজ-শিক্ষা-পরিবেশ আমাকে যে ভাবে প্রভাবিত করেছে আমি তাই।
কিন্তু গত পাঁচ-ছয় দশকের মধ্যে এই ধারণাগুলাের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান- সেটি প্রধানত করেছে জীববিজ্ঞানের আধুনিকতম শাখা যাকে চলতি কথায় বলতে পারি ডিএনএ বিজ্ঞান। এক সময় জীববিজ্ঞানের পক্ষে প্রাণীর দেহ সম্পর্কে গবেষণা করাটাই অতীব সাহসিকতার কাজ ছিল- কারণ প্রাণ জিনিসটি ধরা-ছোঁয়ার বাইরের বিষয় বলে তাকে বিজ্ঞানের অগম্য মনে করা হতাে। সেদিন বহু আগেই গত হয়েছে। বিজ্ঞানের সামনে এ নিয়ে শেষ দুর্ভেদ্য দুর্গটি ছিল মানুষের মন এবং আচরণ। প্রধানত ডিএনএ বিজ্ঞানের এবং মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের অকল্পনীয় অগ্রগতির ফলে এটিও আর দুর্ভেদ্য থাকেনি। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি মানুষের সম্পূর্ণ ডিএনএ'র পাঠোদ্ধার করতে পারার পর এখন স্পষ্ট হয়েছে যে প্রত্যেক মানুষের আত্মপরিচয়ের অনেকখানিই নির্ভর করছে নিজের ডিএনএ’র ওপর যা আমরা পূর্বসূরিদের বিবর্তনের মাধ্যমে কোটি বছরের ধারাবাহিকতায় বাবা-মা থেকে জন্ম লগ্নেই পেয়ে যাই। শুধু আমার দৈহিক গড়ন নয়, আমার চিন্তা-চেতনা-আচরণের মৌলিক ভিত্তিটি তৈরি করে দিচ্ছে এই ডিএনএ। সেই সঙ্গে আমার সুস্থতা, ব্যক্তিত্ব, আবেগ, কালচার ইত্যাদির বিশেষ প্রবণতাগুলাের মধ্যেও ডিএনএ'র হস্তক্ষেপ বেশ স্পষ্ট। এদিক থেকে মানুষ মাত্রই জন্মলগ্নেই সাদা খাতার মত শূন্য হবার পরিবর্তে বরং ওই সব কিছুর ডিএনএ বার্তা দিয়ে একটি ভরা বইয়ের মতই পূর্ণতায় থাকে।
ডিএনএ নিজের বার্তাগুলাের দ্বারা চিন্তা-চেতনা-আবেগের মত মানসিক বিষয়গুলাে বাস্তবায়ন করে প্রত্যেকের মস্তিষ্ক গড়ার মাধ্যমে। ওই মস্তিষ্কের কাজের মধ্যেই রয়েছে আমার মন অর্থাৎ ‘আমি’- এর বাইরে কোথাও নয়। কাজেই আধুনিকতম বিজ্ঞান অনুযায়ী আত্ম-পরিচয়ের জন্য শুধু বাইরের দিকে তাকানাে নয়, বরং তাকাতে হবে নিজের দিকে বিবর্তনের সৃষ্ট এই ডিএনএ-সমগ্রের মধ্যে, এবং মস্তিষ্কের কাজের মধ্যে। মস্তিষ্ক কাজ করে কম্পিউটারের মত তথ্য প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতিতে। আর সেই কাজের জন্য প্রয়ােজনীয় মৌলিক প্রােগ্রামটিই দেয়া আছে জন্মগতভাবে পাওয়া সেই ডিএনএর মধ্যে। তথ্য বাইরে থেকে আসতে পারে, কিন্তু চিন্তার ও আচরণের মৌলিক প্রক্রিয়া ওই প্রােগ্রামের মধ্যেই রয়েছে।
ডিএনএ'র বার্তাগুলাের কতখানি প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হবে তার আবার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে- ওই ডিএনএ’র মধ্যেই। পরিবেশের যে সব বিষয় আচরণ, সুস্থতা, ব্যক্তিত্ব, কালচার ইত্যাদিতে প্রত্যেকের জন্মগত প্রবণতাগুলাে বাড়াকমাকে প্রভাবিত করে, তাও কাজ করে ডিএনএ’র ওই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে। ওই পরিবেশের মধ্যে সব চেয়ে বেশি নেতিবাচক গুরুত্ব পায় মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময় মায়ের ওপর ব্যতিক্রমী দৈহিক ও মানসিক চাপ, শৈশবে একটি সময় পর্যন্ত নিজের ওপর পারিবেশিক চাপ, এবং কিছুটা পরবর্তীতে নিজের ভুল জীবনযাপন অভ্যাস। ডিএনএ'তে থাকা প্রবণতাগুলাের ভিত্তিভূমির সঙ্গে পরিবেশের ভাল-মন্দের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ধরনটির উঘাটন আধুনিকতম বিজ্ঞানের সব চেয়ে দুর্দান্ত সাফল্যগুলাের অন্যতম। এটিই অনেকটা বলে দিচ্ছে আমার ডিএনএ রচিত ভিত্তিভূমিতে যে সব সহজাত ক্ষমতা ও প্রবণতা নিয়ে আমার শুরু, পরে শিক্ষা, চর্চা ইত্যাদি তাকে কীভাবে বিকশিত করার মাধ্যমে আমাকে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘আমিতে পরিণত করে।
সমগ্র মানব ডিএনএ'র পাঠোদ্ধারের পর ওই ভরা বইটি এখন প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এক একটি ভােলা বইও বটে। এর মাধ্যমে এখন দেখছি প্রত্যেক মানুষের ডিএনএ একান্তই তার নিজস্ব হওয়া সত্ত্বেও গড়পড়তা মানুষে মানুষে ডিএনএ’র তফাৎ খুব নগণ্য। একই গােষ্ঠির গড়পড়তা দু'জনের মধ্যে ডিএনএ পার্থক্য যতটুকু, ভিন্ন জাতিসত্ত্বা ভিন্ন গােষ্ঠির দু'জনের মধ্যে পার্থক্য তার চেয়ে বেশি নয়। এটি প্রমাণ করেছে বাহ্যিক নানা বিবেচনায় মানুষে মানুষে যে জাতিগত বিভাজনগুলাে সৃষ্টি করা হয়েছে তা মৌলিকও নয়, নায্যও নয়। আবার ডিএনএ’র সাদৃশ্য দেখলে পুরাে জীবজগতের সঙ্গেও মানুষের ঐক্য অবাক হবার মত। ডিএনএ’র নিরবিচ্ছিন্নতা আমাকে নিজের সীমাবদ্ধ অস্থিত্ব ও কালচারকে ছাড়িয়ে স্থানে ও কালে বিশাল বিস্তৃতি দিয়েছে। দীর্ঘ বিবর্তনঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। সেই ডিএনএই আবার মানবধারার মস্তিষ্কে মননশীলতার অনন্য ক্ষমতা দিয়ে প্রত্যেককে নিজের সহজাত আচার আচরণকে পরিশীলিত করার সুযােগ এনে দিয়েছে।
কয়েক দশকের অল্প সময়ের মধ্যে এই সব দুর্দান্ত আবিষ্কার আত্মপরিচয়ের যে বৈজ্ঞানিক দ্বার খুলে দিয়েছে, তাকে নিয়েই আমাদের এই বই। এই যে উম্মােচন তা যে চমকপ্রদ ফলাফলকে তুলে ধরেছে, বইটিকে শুধু তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি; বরং কী রকম গবেষণা, কী রকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন হয়েছে তারও কিছু স্বাদ পাঠককে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। পুরাে কাহিনীতে একটি যৌক্তিক ধারাবাহিকতা যেন খুঁজে পাওয়া যায় সে জন্য এতে দুটি দিকের ওপর সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একদিকে আত্ম-পরিচয়ের সনাতন প্রশ্নটির উত্তর পেতে আধুনিকতম বিজ্ঞান কীভাবে সহায়তা দিচ্ছে মােটা দাগে তা তুলে ধরা হয়েছে। আবার অন্য দিকে বিবর্তন ও ডিএনএ’র একেবারে অ আ ক খ থেকে শুরু করে আমার ডিএনএ'র পাঠোদ্ধার আমার নিজেকেও কীভাবে অনেকাংশ প্রকাশিত করেছে তার খুঁটিনাটির কিছু সরল বয়ান এতে রয়েছে। আশা করেছি কৌতুহলী অনেকে নিজেদের উম্মােচনের এই বিস্তারিত প্রক্রিয়াটিকে উপভােগ করবেন।
যে কোন বিজ্ঞান এক লাফে আরাধ্য রহস্যটিকে উদঘাটন করতে পারেনা, তাকে শুরুতে খুব সরল উপাদান নিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে এক একটি নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করে করেই জটিলতার দিকে এগােতে হয়। মানুষের আত্মপরিচয়ের মত জটিল বিষয়ের পেছনে অত্যন্ত জটিল সত্যগুলাে খুঁজে পাওয়ার আগে বিজ্ঞানীদেরকে খুবই ধৈর্যশীল সাধনার সঙ্গে মটরশুটির কুঁচকানাে বীজের বা ফলের মাছির চোখের রঙের মত যেসব সরল বিষয়ের ব্যাখ্যা করেই এগােতে হয়েছে- সেই চমকার ধারাবাহিকতা অনুসরণ না করলে এই উদ্মাটনের আসল মজাটাই পাওয়া যাবেনা। সেই দিকটার প্রতিও লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কাজেই শুধু বিজ্ঞানের স্বাদ নয়, বিজ্ঞানীর সাধনার স্বাদও এতে অল্প বিস্তর পাওয়া যাবে বলে আশা রাখি।
আজকের অগ্রগতিগুলাে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে আমরা প্রত্যেকে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন-রহস্য নিজের সমগ্র-ডিএনএর তথ্য হিসেবে স্মার্ট কার্ডের মত সঙ্গে রাখবাে, এবং আমাদের দৈহিক-মানসিক কল্যাণে সে তথ্য ম্যাজিকের মত ব্যবহার করা হবে। সেই সম্ভাবনার পথে এ মুহূর্তে আমরা কোন্ জায়গায় আছি তার কিছু ধারণা দেয়ার ভবিষ্যম্মুখী প্রয়াসটিও এই বইয়ে রাখার চেষ্টা করেছি।
মুহাম্মদ ইব্রাহীম
ফেব্রুয়ারি ২০১৮
Title আমি কে?
Author
Publisher অনন্যা
ISBN 9789844324954
Edition 1st Published, 2018
Number of Pages 297
Country Bangladesh
Language Bengali,

Related Products

Best Selling

Review

0 Review(s) for আমি কে?

Subscribe Our Newsletter

 0