অনেক দিন আগের কথা। হিমালয় পর্বতের পাদদেশ জুড়ে ছিল ছোট্ট একটি রাজ্য। সেই রাজ্যে ছিল অদ্ভুত এক নিয়ম। একবছর পরপর সেই দেশে রাজার পরিবর্তন ঘটত। প্রত্যেক রাজার মেয়াদকাল ছিল একবছর। যিনি রাজপদের ক্ষমতা লাভ করতেন, তাকে এই কথা মেনে নিয়েই রাজ্যভার গ্রহণ করতে হতো যে, একবছর পর যখন তার মেয়াদকাল পূর্ণ হবে, তখন তাকে একটি নির্দিষ্ট শ্বাপদসংকুল দ্বীপে নির্বাসন গ্রহণ করতে হবে। একবছর পূর্ণ হওয়ার পর এক মুহুর্তের জন্যও তাঁর আর রাজপ্রাসাদে থাকার অধিকার থাকতোনা। ঝলমলে রেশমী মসলিন কাপড় পড়িয়ে হাতির পিঠে চড়িয়ে রাজ্যময় ঘুরিয়ে মহাসমারোহে তাকে বিদায় জানানো হত। একবছর রাজকীয় শান শওকতে বসবাস করার পর আচমকা তার এই বাধ্যতামূলক অবসর তার জীবনে রাজ্যের অমানিশা ডেকে আনতো। বেশ ঘটা করে বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা পালনের পর একটা ডিঙি নৌকায় করে তাকে রেখে আসা হতো সেই ভয়াবহ দ্বীপের অনির্দিষ্ট গন্তব্যের পানে। ছেড়ে দেয়া হতো নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। . আবহমান কাল ধরে চলে আসা এই চিরাচরিত প্রথানুযায়ী তারা চলতো। এরই ধারাবাহিকতায় তারা একবার এক রাজার মেয়াদান্তে বিদায়ী রাজাকে সেই মৃত্যুপুরী দ্বীপে রেখে নিজ দেশে ফেরত আসছিল। পথিমধ্যে সমুদ্রের অথৈই পানিতে তখন সদ্য ডুবে যাওয়া একটি বোট তাদের নজরে এলো। বোটের কাছে ভিড়তেই তারা তারুণ্যদীপ্ত এক নওজোয়ান যুবককে দেখতে পেলো। সে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলো এবং খন্ড বিখণ্ড বোটের একটি পাটাতন আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। যেহেতু তাদের একজন নতুন রাজার প্রয়োজন ছিল, তাই তারা যুবকটিকে তুলে নিলো এবং নিজেদের দেশে নিয়ে আসলো। যখন সে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়ে কিছুটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেলো, তখন রাজ্যের অধিবাসীগণ একবছরের জন্য তাকে রাজা হওয়ার প্রস্তাব দিলো। একবছর পরের ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে সে প্রথমে এই লোভনীয় প্রস্তাবটি নাকচ করলেও পরমূহূর্তে তা সাদরে গ্রহণ করলো। তখন তাকে রাজ্যপরিচালনার যাবতীয় নীতিমালা জানিয়ে দেয়া হলো। সেইসাথে, একবছর পর তার চূড়ান্ত ঠিকানার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো। সে নীরবে সব শুনে গেলো। . রাজক্ষমতা লাভের তিনদিন পরে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তলব করে বললেন‚ “পূর্বেকার রাজাগণ যেখানে নির্বাসিত হয়েছিলেন, আমি সেখানে পরিদর্শনে যেতে ইচ্ছুক। যেই কথা সেই কাজ। তিনি সেই বিভীষিকাময় দ্বীপে গিয়ে পৌঁছালেন। দ্বীপটি ছিলো ঘন জঙ্গলে ঘেরা, ভয়ানক প্রাণীদের অভয়ারণ্য। তাদের আগমনের বিষয়টি টের পেয়ে দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানাধরণের হিংস্র জন্তু—জানোয়ার ও মাংসাশী প্রাণীর ডাক ভেসে আসছিলো। রাজা জঙ্গলের একটু গভীরে প্রবেশ করতেই আগের রাজাদের কংকাল, মাথার খুলি ও পচে যাওয়া হাড়গোড় দেখতে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এই শ্বাপদসংকুল দ্বীপে তারা আর কিছুক্ষণ অবস্থান করলেই ক্ষুধার্ত হিংস্র জন্তুগুলো তাদের উপর হামলে পড়ে তাদেরকে খেয়ে শেষ করে দিবে। . এবার রাজা নিজ দেশে ফিরে এসে ১০০ জন দক্ষ ও কর্মঠ শ্রমিক বাছাই করলেন। তাদেরকে সেই দ্বীপে নিয়ে সেখানকার জঙ্গল পরিষ্কার করালেন, সকল আগাছা সাফ করালেন। সকল জীবজন্তু সরিয়ে নিলেন। কাজের অগ্রগতি সরেজমিনে তদারকি করার জন্য তিনি প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার দ্বীপটি পরিদর্শনে আসতেন। প্রথম মাসেই সকল আগাছা কেটে সাফ করা হলো। কিছু জীবজন্তু হটিয়ে বিদায় করা হলো, কিছু প্রাণীকে বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর করা হলো। . দ্বিতীয় মাসে, দ্বীপের সমগ্র সীমানাজুড়ে নানা রকমের ফল—ফলাদি ও রং—বেরংয়ের ফুলগাছের চারা রোপন করা হলো। দ্বীপের একপ্রান্তে হাস—মুরগীর খামার, পাখ—পাখালীর অভয়াশ্রম, গরু—ছাগল সহ নানারকম গৃহপালিত প্রাণীর চারণভূমি তৈরী করা হলো। . তৃতীয় মাসে, সেই দ্বীপে তিনি বিশ্বের স্বনামধন্য প্রকৌশলীদের নিয়োগ দিয়ে এক দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদ তৈরী করলেন। এছাড়া দ্বীপের সুবিস্তৃত সীমানা জুড়ে জাহাজ নোঙ্গর করার জন্য এক অত্যাধুনিক পোতাশ্রয় নির্মাণ করলেন। এই অল্প ক’মাসেই সেই বিভীষিকাময় দ্বীপটি নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়ে গেল। . রাজা বেশ সাদাসিধে ও সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। পরিমিতিবোধ বজায় রেখে অর্থব্যয় করতেন। একটি দেশের রাজা হিসেবে যেমন জাকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করা দরকার, তার কিঞ্চিৎ পরিমাণও তিনি করতেন না। তার উপার্জিত সকল আয় তিনি সেই দ্বীপের ধনভাণ্ডারে সঞ্চিত করে রাখতেন। . যখন নবম মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলো, রাজা তখন সকল মন্ত্রীদের ডেকে বললেন, “আমার একথা ভালোভাবেই মনে আছে যে, আমার দায়িত্বভার গ্রহণের বছরপূর্তি হওয়া মাত্রই আমাকে সেই দ্বীপে চলে যেতে হবে। তবে আমি এখনই সেখানে চলে যেতে চাই।” কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ তার একথা মানতে নারাজ। তাদের কথা একটাই, রাজ্যের চিরাচরিত প্রথার ব্যত্যয় ঘটিয়ে একবছর পূর্ণ হওয়ার আগে সেখানে যাওয়া যাবেনা। বছরপূর্তি হওয়া মাত্রই তাকে সেই দ্বীপে পাঠিয়ে দেয় হবে। তার আগে নয়। এরপর দেখতে দেখতে বাকী তিনমাসও পূর্ণ হয়ে গেলো। পূর্বেকার রাজাদের মতো তাকেও জমকালো পোশাক পরিয়ে, হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা রাজ্যময় প্রদক্ষিণ করানো হলো। তিনি হাত নেড়ে হাসিমুখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তার এই হাস্যজ্জ্বোল অভিব্যাক্তি দেখে জনগণ তাজ্জব বনে গেলো। পূর্বেকার সকল রাজা—বাদশাহগণ বিদায় কালে কেঁদে জারে জার হয়ে পড়তেন। আর এই রাজা দেখি বিদায়কালে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আছে! কয়েকজন হতবিহবলতা কাটিয়ে সরাসরি রাজাকেই তার উৎফুল্লতার কারণ জিজ্ঞেস করে বসলো। . জবাবে সদ্যবিদায়ী রাজা বললেন, রাজক্ষমতা লাভের একবছর মেয়াদকালে যখন অন্যান্য রাজা—বাদশাহগণ ভবিষ্যতের পরিণতির কথা ভুলে গিয়ে ভোগ বিলাসিতায় মত্ত ছিল, আমোদ—ফুর্তিতে ডুবে ছিল, মোজ—মাস্তিতে বিনোদিত ছিল, সেই সময়টা আমি আমার ভবিষ্যত বিনির্মাণে ব্যস্ত ছিলাম। সেই মৃত্যুপুরী দ্বীপকে বসবাসযোগ্য বসুন্ধরায় পরিণত করেছি। নান্দনিক বাসভবন, বৈচিত্র্যময় পুষ্পের মৌ মৌ সুগিন্ধতে ভরপুর ফুলবাগিচা, পাখ—পাখালির কলকাকলিতে মুখরিত নয়নাভিরাম উদ্যান দ্বীপটিকে করে তুলেছে নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে। দ্বীপটির প্রান্তসীমায় নবনির্মিত জাহাজের অত্যাধুনিক পোতাশ্রয়টি দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সচল করেছে। আশা করা যায়, বাকী জীবনটি আমি বেশ শান্তিতেই দিনাতিপাত করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।” . এই গল্পের শিক্ষণীয় বিষয় হলো‚ আমাদের জীবনাচার কেমন হওয়া উচিত? . পরকালীন অনন্ত জীবনের প্রস্তুতির মাঝেই আমাদের এই ইহকালীন ক্ষণস্থায়ী জীবনকে অতিবাহিত করা চাই। পার্থিব জীবনের সাময়িক মোহে বিভোর হয়ে পড়লে পরকালীন জীবনের অনন্ত সুখ—সমৃদ্ধি আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। এমনকি আমরা যদি রাষ্ট্রপতিও হয়ে থাকি তারপরও আমাদের লাইফ স্টাইল হওয়া চাই মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মতো অনাড়ম্বর জীবন। আমাদের আখিরাতের জীবন যেন সুখময় হয়, সুখ—সমৃদ্ধির ফল্গুধারায় যেন বিকশিত হয়, এইজন্য পবিত্র কুরআন আমাদেরকে দিয়েছে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। আল্লাহ তাআলা বলেন, . “মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত আগামীকালের জন্যে সে কি প্রেরণ করবে তা চিন্তা করা। আল্লাহ তাআলাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তাআলা সে সম্পর্কে খবর রাখেন।” (সূরা হাশর : ১৮) . বই : মৃত্যু যখন উপহার লেখক : মোঃ মতিউর রহমান এছাড়াও বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় বই দ্য কেয়ারিং হাজব্যান্ড ও দ্য কেয়ারিং ওয়াইফ সহ প্যাকেজটি অর্ডার করুন এখনই।
Title | কেয়ারিং হাজব্যান্ড- ওয়াইফ ও মৃত্যু যখন উপহার প্যাকেজ |
Author | মোঃ মতিউর রহমান, Md. Matiur Rahman |
Publisher | মিফতাহ প্রকাশনী |
ISBN | 97898495434289789843 |
Edition | 1st Published, 2021 |
Number of Pages | 440 |
Country | Bangladesh |
Language | Bengali, |
0 Review(s) for কেয়ারিং হাজব্যান্ড- ওয়াইফ ও মৃত্যু যখন উপহার প্যাকেজ