মুখবন্ধ
এই লেখাটি দৈনিক 'বাংলাবাজার পত্রিকা'র সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় প্রায় চার মাস ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার কিস্তিগুলো পাঠ করে তাৎক্ষণিকভাবে অনেকেই তারিফ করেছিলেন। তার মধ্যে অধ্যাপক রাজ্জাকের প্রাক্তন ছাত্র এবং কতিপয় ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিও ছিলেন। আবার কতিপয় মানুষের মুখে এরকম অভিযোগও উচ্চারিত হতে শুনেছি, আমি যেসব কথা অধ্যাপক রাজ্জাকের জবানিতে প্রকাশ করেছি, আসলে সেগুলো রাজ্জাক সাহেব বলেননি, আমি নিজে বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি।
একটি লেখা যখন কাগজে প্রকাশিত হয়, তা সকল পাঠকের মনে সমান আবেদন সৃষ্টি করে না। কারও ভালো লাগে, কারও লাগে না। আমার লেখাটির ব্যাপারেও পক্ষে বিপক্ষে কে কী বললেন সেটা আমার বিশেষ বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠেনি। আমি যে জিনিসটির উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম আমার শিক্ষক অধ্যাপক রাজ্জকের অনন্য ব্যক্তিত্বের মহিমা আমি যেভাবে অনুভব করেছি, অন্তত তার কিছুটা উত্তাপ দশজনের কাছে প্রকাশ করি। মুখ্যত এই উদ্দেশ্য নিয়েই রচনাটি লিখতে প্রবৃত্ত হই। স্যারের কাছে উনিশ'শ সত্তর সালের শেষের দিকে যাওয়া-আসা শুরু করেছিলাম, এখনও সেই প্রক্রিয়াটির ইতি ঘটেনি।
আমার স্বভাবটাই এমন, একজন মানুষ, তিনি যতো বড় ব্যক্তিত্বই হোন, বেশিদিন আমার আগ্রহ এবং কৌতূহল উদীপ্ত রাখতে পারেন না। অতি সহজেই তাঁরা পুরনো হয়ে যান। তখন তাঁদের ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় থাকে না। স্বভাবের এই একবোকা প্রবণতাটির জন্য জীবনে আমি কম দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হইনি। সাতাশ বছর ধরে রাজ্জাক স্যারের সান্নিধ্য লাভ করে আসছি, রাজ্জাক সাহেব আমার কাছে একদিনের জন্যও পুরনো হয়ে যাননি। প্রতিবারই তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং জানাশোনার পরিধি আমার চোখে নতুন নতুন চমক সৃষ্টি করেছে। প্রথম দিন তাঁর সঙ্গে কথা বলে যেভাবে বিস্মিত হয়েছিলাম, এখনও একই ধরনের বিস্ময় তিনি আমার মধ্যে
সৃষ্টি করেন। ভক্তি কিংবা শ্রদ্ধার প্রকাশ এ রচনায় কতটুকু ঘটেছে আমি তা জানিনে। বিষয়বোধের কারণেই স্যারের উপর এ রচনাটি লিখতে বাধ্য হয়েছি।
আমার এ রচনাটিকে কেউ যদি নিছক সাক্ষাৎকারধর্মী রচনা মনে করেন, আমার ধারণা, লেখাটির উপর কিঞ্চিৎ অবিচার করা হবে। আমি রাজ্জাক স্যারের সমগ্র ব্যক্তিত্বটি স্পর্শ করতে চেষ্টা করেছি। আমার অক্ষমতার পরিমাণ অপরিসীম। আমি রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে যত জানি, তাঁকে যতদূর বুঝতে পারি, এসব বিষয়ে আমার চাইতে ঢের ঢের কামেল ব্যক্তি সংসারে এখনও বেঁচে-বর্তে রয়েছেন। আর রাজ্জাক স্যারের উপর লেখা এটি একমাত্র গ্রন্থ নয়।
রাজ্জাক স্যারের ওপর কোনোকিছু লিখে প্রকাশ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। এই ঝুঁকি দু'দিক থেকেই। রাজ্জাক স্যার নানা স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন একতরফা মতামত দিয়ে বসেন, যেটা সমাজের মানুষ বরদাশত করতে অনেক সময়ই প্রস্তুত নয়। অন্যদিকে তাঁর বক্তব্যের উপস্থাপনায় যদি সামান্য হেরফেরও ঘটে যায়, তিনি সেটা সহজভাবে মেনে নিতে রাজি হবেন না। এই দু'ধরনের ঝুলন্ত খড়গ মাথার ওপর রেখে রচনাটি আমাকে লিখতে হয়েছে। এ গ্রন্থের সব কথা রাজ্জাক সাহেবের। কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সংযোজিত করেছি। এটি করতে গিয়ে দু'ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা প্রশ্রয় পেয়েছে। কোথাও কোথাও তাঁকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কারও কারও দৃষ্টিতে তা অনাবশ্যক বড় করে দেখানো বলে প্রতিভাত হতে পারে। প্রথম পুরুষে যেহেতু রচনাটি লিখিত হয়েছে, লেখকের ভূমিকাটি কোথাও কোথাও প্রবল হয়ে উঠেছে, এমন মনে হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়।
রাজ্জাক স্যারের অত্যন্ত স্নেহভাজন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামানকে এ রচনাটির মুখবন্ধ লিখে দেয়ার জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলাম, তিনি রাজিও হয়েছিলেন। পরে ভেবে দেখলাম এই লেখায় আমি অনেকগুলো গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছি। আমার অপরাধ- খালনের বোঝা আমার শিক্ষকের ওপর আরোপ করা ঠিক হবে না বলেই মুখবন্ধটি রচনার দায়িত্বটি নিজেকে গ্রহণ করতে হলো।
উত্থানপর্ব কার্যালয়
৭১ আজিজ সুপার মার্কেট 'ঢাকা ১০০০
১লা ফাল্গুন ১৪০৪
আহমদ ছফা
Title | যদ্যপি আমার গুরু |
Author | আহমদ ছফা, Ahmad Chafa |
Publisher | মাওলা ব্রাদার্স |
ISBN | |
Edition | 9th Edition - April , 2022 |
Number of Pages | 110 |
Country | Bangladesh |
Language | Bengali, English, |
0 Review(s) for যদ্যপি আমার গুরু